হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় হ্যানিম্যানের অর্গানন অব মেডিসিন সূত্র: ০২

সূত্রঃ (২)
আরোগ্যবিধানের উচ্চতম আদর্শ হইল দ্রুত, বিনাকষ্টে ও স্থায়িভাবে স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার, কিংবা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে, সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও নির্দোষ উপায়ে, সহজবোধ্য নীতির সাহায্যে সমগ্রভাবে রোগের দূরীকরণ ও বিনাশ।

ভাষ্য (২): দ্বিতীয় সূত্রে হ্যানিম্যান চিকিৎসার উচ্চতম আদর্শের কথা উল্লেখ করিয়াছে। প্রায় দুই হাজার বৎসর পূর্বে অ্যাসক্লিপিয়েডিস নামক জনৈক গ্রীক চিকিৎসকও উক্ত মর্মে চিকিৎসার আদর্শ সম্বন্ধে ঘোষণা করিয়াছিলেন। তাঁহার আদর্শের সারমর্ম ছিল; অতিদ্রুত নির্বিঘেœ ও সুখকর উপায়ে রোগের আরোগ্যবিধান করিতে হইবে। কিন্তু সেই আদর্শ তাঁহার কল্পনাতেই আবদ্ধ ছিল, সুদীর্ঘকাল পরে তাহাকে বাস্তবে রূপায়িত করিলেন হ্যানিম্যান।

দ্বিতীয় সূত্রে আদর্শ আরোগ্য প্রসঙ্গে হ্যানিম্যান কয়েকটি শর্ত আরোপ করিয়াছেন। তার প্রথমটি হইল-আরোগ্যবিধানের গতি দ্রুত হওয়া চাই। অবশ্য সকল চিকিৎসাপদ্ধতিতেই দ্রুত আরোগ্যবিধানের কথা স্বীকৃত হইয়াছে। সুতরাং এই উক্তি বাহুল্য মনে হইলেও আদর্শ আরোগ্য সম্বন্ধে বিবেচনা করিতে হইলে এই প্রয়োজনের স্থান সর্বাগ্রে।

দ্বিতীয় শর্ত হইল, আরোগ্যবিধানকার্যে যতদূর সম্ভব বিনা কষ্টে ও নির্দোষভাবে সাধন করিতে হইবে। আগুনে ঘৃতাহুতি দিবার মতো যদি রোগযন্ত্রনার উপর আরও যন্ত্রণা চাপানো হয় তাহা হইলে রোগীর অবস্থা আরও শোচনীয় হইয়া পড়ে। হ্যানিম্যানের সময়ে চিকিৎসা ব্যাপারে নানারূপ আসুরিক পদ্ধতি ও প্রকরণের ব্যবস্থা ছিল; এমন কি পচন নিবারণের জন্য কোন আহত অঙ্গকে ফুটন্ত তৈলে কিংবা আলকাতরার মধ্যে ডুবানো হইত। তাহার যে কী ভীষণ যন্ত্রণা তাহা সহজেই অনুমেয়। তাহার স্থানে কষ্টবিহীন কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে পারিলে রোগীর পক্ষে কত না সুখের হয়। হ্যানিম্যান সেইজন্যই আদর্শ চিকিৎসার একটি অঙ্গরূপে কষ্টবিহীন চিকিৎসার কথা উল্লেখ করিয়াছেন। অধুনা ইঞ্জেকশনের ফোঁড়াফুঁড়ি ব্যবস্থাকেও অনেকে কষ্টবিহীন চিকিৎসার অন্তর্গত বলিয়া গণ্য করিতে না পারেন। হ্যানিম্যানের মনে কিন্তু তৎকালীন উৎকট আসুরিক চিকিৎসার কথাই স্থান পাইয়াছিল।

চিকিৎসার আদর্শ সম্বন্ধে তৃতীয় প্রয়োজন হইল স্থায়িভাবে আরোগ্যবিধান। পীড়াহেতু দেহ ও মনে যে অসুখ ও অশান্তি আসে তাহা বিদূরিত করিয়া স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে ফিরাইয়া আনাই হইল চিকিৎসার উদ্দেশ্য। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সাধিত না হইয়া যদি শুধু সাময়িক উপশম আসে কিংবা সাময়িক উপশমের পরে আবার অন্য কোন উপসর্গ আসিয়া উপস্থিত হয় তাহা হইলে সেই চিকিৎসাকে আদর্শ চিকিৎসা কখনই বলা চলে না, এবং তাহা চিকিৎসকের কখনও কাম্য হইতে পারে না।

চিকিৎসার অন্যতম আদর্শ হইল সমগ্রভাবে রোগের দূরীকরণ। পীড়ার যখন উৎপত্তি হয় তখন দেহে ও মনে নানাবিধ লক্ষণ প্রকাশিত হয়। সেগুলির কয়েকটি উৎকট যন্ত্রনাদায়ক হইতে পারে, আবার কতকগুলি হয়তো অপেক্ষাকৃত কম যন্ত্রণাদায়ক। যদি এরূপভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় যাহাতে লক্ষণগুলির মাত্র আংশিক উপশম হয় তাহা হইলে সেই চিকিৎসাকেও আদর্শ বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে না। সমগ্রভাবে সমস্ত লক্ষণগুলি বিদূরিত হইলে তবেই তাহা আদর্শ চিকিৎসা।

আরোগ্যবিধান নির্দোষভাবে হওয়া চাই। হ্যানিম্যানের সময়ে শিরা কাটিয়া রক্ত বাহির করিয়া দিয়া, কোন স্থান পুড়াইয়া ক্ষত করিয়া কিংবা অন্য কোন উৎকট পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া যেসব চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল সেগুলিকে কখনই নির্দোষ বলা চলে না। তাহাতে অতিরিক্ত রক্ত ও রসের ক্ষণরহেতু রোগী স্বভাবতই অত্যান্ত দুর্বল হইয়া পড়িত এবং তাহার ফলে রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হইয়া যাওয়ায় রোগীর অন্য কোন মারত্বক রোগে আক্রান্ত হইবার প্রবণতা বৃদ্ধি পাইত। সুতরাং এই প্রকার ক্রটি ও দোষমুক্ত চিকিৎসাপদ্ধতিকে আদর্শ চিকিৎসা বলিয়া ধরা যায় না।

সবশেষে হ্যানিম্যান বলিয়াছেন, আদর্শ আরোগ্যের মূলে থাকা চাই-এক সহজবোধ্য নীতি যাহার সাহায্যে অভ্রান্তভাবে চিকিৎসা পরিচালনা করা সম্ভব। কল্পনা বা অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া কিংবা ধারণা অতীত কোন ক্রিযাকে আশ্রয় করিয়া অনেক সময়ে হয়তো রোগের উপশম বা আরোগ্যলাভ সম্ভবপর হইতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত কোন সুদৃঢ় নীতির উপর সেই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠিত নহে। বিশেষ কোন ক্ষেত্রে উপকার দেখা গেলেও সবক্ষেত্রে তাহা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। গণনার সাহায্যে বৈজ্ঞানিকগণ যে সকল নৈসর্গিক ঘটনাবলী অভ্রান্তভাবে ঘোষণা করেন তাহার ভিতরে পাওয়া যায় এক অপরিবর্তনীয় চিরন্তন নীতি। সেই নীতি সর্বকালে সত্য ও অমোঘ এবং অনুকরণীয়। কিন্তু যে পদ্ধতির ভিতরে কোন প্রয়োগনীতি খুঁজিয়া পাওয়া যায় না তাহা দুর্বোধ্য, এবং তাহা কখনও চিকিৎসার আদর্শ নীতিরূপে গৃহীত হইতে পারে না।


সূত্র: র্অগানন অফ মডেসিনি (হ্যানমোন), ডাঃ শ্রী ত্রগিুণানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

Comments

Popular posts from this blog

কেবি মডেল টেস্ট এর প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে........

কারিগরি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ কেন?

১.১০. পিএইচপি প্রশিক্ষণ