হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় হ্যানিম্যানের অর্গানন অব মেডিসিন সূত্র: ০১


হোমিওপ্যাথিক অর্গানন অব মেডিসিন সুত্র নং: ১
চিকিৎসকের মহৎ ও একমাত্র উদ্দেশ্য হইল রোগীকে স্বাস্থ্যে ফিরাইয়া আনা, যাহাকে বলা হয় আরোগ্য বিধান করা।১
১তাঁহার (চিকিৎসকের) উদ্দেশ্য ইহা নহে যে দেহের ভিতরকার প্রাণক্রিয়ার প্রকৃত স্বরূপ কি, এবং দেহযন্ত্রেও অদৃশ্য অভ্যন্তওে কিভাবে পীড়ার উৎপত্তি হয় সে বিষয়ে ফাঁকা কল্পনা ও অনুমানের জাল বুনিয়া তথাকথিত ব্যবস্থাপদ্ধতি তিনি রচনা করিবেন। (এইভাবে কত চিকিৎসকের কাম্য নহে যে একদিকে পীড়িত মানব সাহায্যেও আশায় বৃথা দীর্ঘশ্বাস ফেলিবে আর একদিকে পীড়ার অদ্ভুত বৈচিত্র্য বিষয়ে অসণিত ব্যাখ্যা এবং তাহার আনুমানিক কারণ-(যাহা কোনকালেই গোচরীভূত হইবে না)-দুর্বোধ্য ভাষা এবং অসার ও জটিল ব্যঞ্জনার মাধ্যমে প্রকাশ করিয়া অজ্ঞ লোকদের কাছে তাহা পান্ডিত্যপূর্ণ বলিয়া ধারণা জন্মাইয়া দিয়া তাক লাগাইয়া দিবেন। এই প্রকার পান্ডিত্যপূর্ণ অলীক কল্পনা -(যাহার নাম দেওয়া হইয়াছে তত্ত্বমূলক চিকিৎসাবিজ্ঞান, এবং যাহার জন্য বিশেষ অধ্যাপকপদসমূহের সৃষ্টি করা হইয়াছে)-আমরা অনেক দেখিয়াছি। এখন চিকিৎসক নামধারী সকলেরই সেই সময় উপস্থিত যখন কেবলমাত্র বাগাড়ম্বর দ্বারা আর্ত মানবকে প্রতারিত করা হইতে বিরত থাকিয়া তাহার পরিবর্তে তাহারা প্রকৃত সাহায্য ও আরোগ্যবিধানকার্য শুরু করিবেন।
ভাষ্য(১): হ্যানিম্যানের সময়ে চিকিৎসক সমাজে এনরূপ ধারণা প্রচলিত ছিল যে রোগের উৎপত্তির মূলীভূত কারণ হইল কোন উগ্র প্রকৃতির জড়ীয় পদার্থ, যাহা শরীরের ভিতর লুকাইয়া থাকিয়া ব্যাধির সৃষ্টি করে। কল্পনা ও অনুমানের ভিত্তির উপরেই এই ধারণা গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই ধারণার অনুবর্তী হইয়া চিকিৎসকগণের চিকিৎসাপ্রণালী তখন অনুসৃত হইত। তাঁহারা মনে করিতেন যে রোগাৎপাদক মূল কারণটিকে দেহ হইতে বাহির করিয়া দিতে পারিলেই রোগ সারিয়া যাইবে। সেইজন্য তাঁহারা বমনকারক, শ্লেস্মা ও লালানিঃসারক, ঘর্মোৎপাদক, বিরেচক প্রভৃতি উগ্র ঔষধাদি-প্রয়োগ করিয়া সেই দূষিত পদার্থটিকে দূর করিবার চেষ্টা করিতেন। কষনও চিকিৎসকগণ জোঁক লাগাইয়া রোগীর শরীর হইতে রক্ত বাহির করিয়া দিতেন, তখনও বেদনাস্থানে প্রদাহজনক কোনো উগ্র প্রলেপ লাগাইয়া সেই স্থান পুড়াইয়া ক্ষত উৎপাদন করিতেন। এই সকল প্রক্রিয়ার ফলে রোগী কখনও কখনও সাময়িকভাবে উপশম বোধ করিলেও ত তাহাতে স্থায়ী কোন সুফল লাভ হইত না। বরং দেহ হইতে রস ও রক্তের প্রভূত অপচয় হেতু রোগী আরও দুর্বল হইয়া পড়িত, এবং তাহার ফলে তাহার রোগপ্রবণতা আরও বাড়িয়া যাইত। হ্যানিম্যানের যুগের সেই স্থুল ধারণা ও ততোধিক উৎকট চিকিৎসাপদ্ধতি বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে আর প্রচলিত না থাকিলেও রোগোৎপত্তির কারণ যে ভৌতিক পদার্থ অর্থাৎ জীবাণূসমূহ-এই মতবাদ বৈজ্ঞানিক সমাজে এষনও স্বীকৃত। তদনুসারে চিকিৎসারও প্রচলন রহিয়াছে এবং নিত্য পরিবর্তশীল নূতন নূতন চিকিৎসার ব্যবস্থাও আবিস্কৃত হইতেছে। আলেয়ার পিছনে ছুটিতে ছুটিতেই চিকিৎসকের সমস্ত প্রতিভা ও শক্তি ব্যয়িত হইয়া যায়, এবং তাহার ফলে তাঁহারা যে অনিশ্চিত মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন তাহা যেমন ধোঁয়াটে তেমনি জটিল। এইরূপ আনুমানিক সিদ্ধান্ত লইয়া তাঁহারা পান্ডিত্যের গর্বে স্ফীত হইতে পারেন বটে কিন্তু তাহাতে রোগীর রোগনিরাময় হয় না কিংবা তাহার রোগকাতর আর্তনাদ দূরীভূত হয় না। সেইজন্য এই প্রথম সূত্রে ও তাহার পাদটীকায় চিকিৎসকের একমাত্র কর্তব্য হইল রোগীকে আরোগ্য প্রদান করা, কল্পনার বশে অদৃশ্য কারণের কথা অনুসন্ধানে আড়ম্বরপূর্ণ জটিল ধাঁধাঁর সৃষ্টি করা নয়।
এই উক্তি শুধু হ্যানিম্যানের নিকট হইতেই আমরা পাই তাহা নহে। প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। মহর্ষি চরক ভেষজ ও চিকিৎসকের যোগ্যতা নির্ণয় করিয়া বলিয়াছেন:
‘সেই ভেষজই যথার্থই ঔষধ যাহা রোগ দূর করিতে পারে,
সেই ব্যক্তিই প্রকৃত চিকিৎসক যিনি আরোগ্য প্রদান করিতে পারেন।’

সূত্র: র্অগানন অফ মডেসিনি (হ্যানমোন), ডাঃ শ্রী ত্রিগুণানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

হোমিওপ্যাথিক অর্গানন অব মেডিসিন সুত্র নং: ১
The physician's high and only mission is to restore the sick to health, to cure, as it is termed.1
সূত্র-০১, চিকিৎসকের মহৎ এবং একমাত্র কাজ পীড়িতকে সুস্থ করা, আরোগ্য, যেহেতু একেই বলা হয়।

ব্যাখ্যা:- এ-সূত্রটি অর্গানন অব মেডিসিন নামক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রথম নির্দেশনা। হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা এ-পুস্তকেই দিয়েছেন। তিনি তার মেটিরিয়া মেডিকা পিউরার প্রিঅ্যাম্বলের(Preamble) প্রথমেই এ-কথাটি বলেছেন। তার প্রথম নির্দেশনায় তিনি চিকিৎসাকার্যকে চিকিৎসকের সর্বোচ্চ এবং একমাত্র কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি চিকিৎসকের কাজ বুঝাতে ‘mission’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একনিষ্ঠ কাজ বুঝাতে ‘mission’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তিনি মনে করেন যে, চিকিৎসাকার্যই চিকিৎসকের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত।

চিকিৎসাপ্রণালী অন্বেষণ করা, এবং চিকিৎসাপদ্ধতি প্রণয়ন করা চিকিৎসকের কাজ ও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু প্রাক-হ্যানিম্যান যুগে সঠিক কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল না। যা কিছু কিছু চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল তা-ও ছিল খুব নির্যাতনমূলক এবং কষ্টদায়ক, কিন্তু আরোগ্য-সহায়ক ছিল না। এই কারণে চিকিৎসকগণ রোগী চিকিৎসার চেয়ে চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বেশি ব্যস্ত থাকতেন।

হ্যানিম্যানের আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাপদ্ধতি, ‘অর্গানন অব মেডিসিন’ নামক পুস্তকের মাধ্যমে প্রকাশের পর চিকিৎসাপদ্ধতির অভাব দূর হয়। প্রকৃত চিকিৎসাসেবা দেয়ার দ্বার উন্মোচন হয় এবং চিকিৎসার মান উন্নত হয়। কাজেই আরোগ্যের সংজ্ঞাও পরিবর্তন করা হয়। রোগীকে নির্জীব করে রোগ দমন করার চিকিৎসা পরিত্যাগ করে হ্যানিম্যান রোগীকে সুস্থ করার চিকিৎসানীতি গ্রহণ করেন এবং নতুন করে আরোগ্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করেন। তিনি রোগের নামভিত্তিক চিকিৎসা পরিত্যাগ করে রোগীর অসুস্থতার (sickness) উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। কারণ শত পরীক্ষা ও অন্বেষণ করেও রোগীর দেহাভ্যন্তরে কোনো রোগসত্তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। নিদানগত যে পরিবর্তন পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে রোগের ফল। আর নিদানগত কিছু পাওয়া না গেলে তো বলতেই হয়, ‘তার কোনো রোগ নেই’। অথচ রোগী দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, দেহ ও মনে নানা রকম কষ্ট অনুভব হচ্ছে। প্রাচীন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। তারা চিনেন শুধুমাত্র নিদানগত পরিবর্তন। আগেতো মানুষ অসুস্থ হয় তারপর ধীরে-ধীরে নিদানগত পরিবর্তন শুরু হয়। 

কাজেই হ্যানিম্যান মনে করেন যে, জীবনীশক্তির বিশৃঙ্খলার জন্য মানুষ অসুস্থতাবোধ করে। এবং জীবনীশক্তির বিশৃঙ্খলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষ অসুস্থই থাকে, যদিও এ-সময়ে তার মধ্যে নানারূপ রোগলক্ষণ উৎপন্ন হয়। এ-সব রোগলক্ষণ অসুস্থতার বহির্প্রকাশ মাত্র। অতএব রোগীর অসুস্থতা দূর করে তাকে সুস্থ করা এবং সাবেক স্বাস্থ্যে ফিরিয়ে নেয়ার নামই আরোগ্য করা। রোগলক্ষণ দূর হওয়া সত্ত্বেও যদি রোগীর সুস্থতা অর্জিত না হয় এবং সাবেক স্বাস্থ্যের প্রত্যাবর্তন না হয় তাহলে তাকে আরোগ্য বলা যাবে না। তাকে রোগের উপশম বলা যেতে পারে। এভাবে হ্যানিম্যান রোগের উপশম এবং আরোগ্যের মধ্যে তফাৎ নির্ণয় করেছেন এবং বলেছেন যে, কেবলমাত্র হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকলাই রোগের নির্মূল আরোগ্য নিশ্চিত করতে পারে। তিনি তার দি লেসার রাইটিংস্ পুস্তকে “ALLOPATHY” শিরোনামে ৭৫২ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, “The homœopathic medical art can alone transform into health, as if by magic, all natural diseases not ruined by allopathic art, Provided there remain a tolerable amount of vital force.” অর্থাৎ, “হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকলাই কেবল, যেন ম্যাজিকের মতো, সকল প্রাকৃতিক ব্যাধিসমূহ যা এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসাকলা কর্তৃক ধ্বংস হয় নি তা, সুস্থতায় রূপান্তরিত করতে পারে, যদি জীবনীশক্তি মোটামুটিভাবে ভালো থাকে।”

সূত্র: হোমিওপ্যাথিক অর্গানন অব মেডিসিন, অধ্যাপক ডা: রেজাউল করিম।

Comments

Popular posts from this blog

কেবি মডেল টেস্ট এর প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে........

কারিগরি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ কেন?

১.১০. পিএইচপি প্রশিক্ষণ